মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনে ইসলামপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরকালীন মুক্তির জন্য ইসলামী খেলাফত বা রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নির্ভেজাল তাওহিদ বা শিরকমুক্ত ঈমান বজায় রাখা, হালাল-হারাম উপার্জনের নিশ্চয়তা, জিনা-ধর্ষণ, হত্যারোধ, বৈষম্যমুক্ত অর্থনীতি প্রচলনসহ ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইনের বাস্তবায়নে ইসলামী খেলাফত বিকল্পহীন একটি ব্যবস্থা। তাই এটিই ইসলামের একটি বড় ও জরুরি ফরজ। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর নির্দেশ ও ঘোষণা হচ্ছে- ১. নিশ্চয়ই পৃথিবীতে আমি খলিফা (প্রতিনিধি শাসক) পাঠাব। (সূরা বাকারা, আয়াত-৩০)
২. আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানানুযায়ী যারা বিচার করে না, তারা কাফির। যারা আল্লাহর বিধানানুযায়ী বিচারকার্য সম্পাদন করে না, তারা জালিম। যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার করে না, তারা ফাসিক। (সূরা মায়িদা, আয়াত : ৪৪-৪৫-৪৭)
৩. আমরা আমাদের রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি সুস্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সাথে নাজিল করেছি কিতাব ও মিজান (দাঁড়িপাল্লা), যাতে লোকেরা ন্যায়বিচার করতে পারে। আমি লৌহ নাজিল করেছি, যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। (সূরা আল-হাদিদ, আয়াত-২৫)
৪. হে রাসূল, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, আপনি তা দিয়ে বিচার-ফায়সালা/শাসন করুন। আপনার কাছে যে সত্য এসেছে, সে ব্যাপারে ওদের মনগড়া কথাবার্তার অনুসরণ করবেন না। (সূরা মায়িদা, আয়াত-৪৯)
৫. নিশ্চয়ই আমি আপনার ওপর সত্যতার সাথে কিতাব নাজিল করেছি, যাতে করে আপনি আল্লাহর দেখানো বিধান দিয়ে লোকদের মধ্যে বিচার ফায়সালা করতে পারেন। আর আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে ওকালতি করবেন না। (সূরা নিসা, আয়াত-১০৫)
৬. হে দাউদ, আমি আপনাকে পৃথিবীতে খলিফা বানিয়েছি। অতএব, আপনি মানুষের মধ্যে সত্যতার সাথে বিচার-ফায়সালা করুন। প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। (সূরা সাদ, আয়াত-২৬)
৭. তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। (সূরা বাকারা-১০২)
৮. তিনি সেই মহান সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ পাঠিয়েছেন যেন তাঁকে সব দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন। (সূরা সফ-৯)
আর আল্লাহর এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা: মদিনায় হিজরত করে প্রথম সুযোগেই মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামী খেলাফত বা রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন। এক্ষেত্রে রাসূল কর্তৃক সম্পাদিত মুসলিম-অমুসলিমদের সহাবস্থান ও সমঝোতাভিত্তিক ‘মদিনা সনদ’ মূলব্যবস্থাপত্র হিসেবেই কাজ করেছে। মদিনায় বসবাসরত মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সব গোত্রের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুহাম্মদ সা: কর্তৃক সম্পাদিত ৪৭ ধারাসম্বলিত সংবিধানটিই পৃথিবীর ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই প্রথম লিখিত চুক্তি ও সংবিধান, যা ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ এক হিজরিতে প্রণীত হয়। আর হুদাইবিয়ার সন্ধি ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে (৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে) মদিনা শহরবাসী এবং মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সম্পাদিত একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। এই সন্ধিটি মক্কা ও মদিনার মধ্যে ১০ বছরব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে এবং মুহাম্মদ সা:কে পরের বছর ওমরার জন্য মক্কায় প্রবেশে অনুমোদন দেয়। অথচ এসব চুক্তির আগে কাফির-মুশরিকরা রাসূল সা:কে আরবের শাসনভার গ্রহণের পাশাপাশি সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে বিয়ের সমঝোতামূলক প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু রাসূল এক হাতে চন্দ্র এবং আরেক হাতে সূর্য এনে দিলেও তাদের সমঝোতা প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে, তিনি মক্কার শাসনভার গ্রহণ করে বাধাহীনভাবে ইসলামী খিলাফত এবং আইন-কানুন জারির সহজ পন্থা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করে এত যুদ্ধের মাধ্যমে সেই ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠাই বা করতে গেলেন কেন? কারণ অনৈসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আওতায় শাসনক্ষমতা নিলেও সমমনা জনগণ ও নেতৃত্ব কিংবা জনগণের পরকালীন জবাবদিহিতামূলক জীবনবোধসহ নৈতিক চরিত্রের সংশোধন ব্যতীত ইসলামী খিলাফত কায়েম করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই ইসলামপন্থীদের খিলাফতদানের জন্য আল্লাহর শর্তই হচ্ছে-
৯. তোমাদের মাঝে যারা ঈমান আনবে এবং সৎকার্যসমূহ সম্পাদন করবে, আল্লাহ তাদের সাথে ওয়াদা করছেন যে, তিনি তাদের পৃথিবীতে খিলাফত (আল্লাহর প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনক্ষমতা) দান করবেন, যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের খিলাফত দান করেছিলেন। (সূরা নূর, আয়াত-৫৬)
ওই আয়াতে আল্লাহ ঈমান আনার পর সৎকর্ম সম্পাদন করাকেই ইসলামী খেলাফতপ্রাপ্তির শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সৎকর্ম বলতে মূলত হক্কুল ইবাদ অর্থাৎ মানবসেবা, অধিকারপ্রতিষ্ঠা এবং হক্কুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর অধিকার বলতে তার প্রতি শিরকমুক্ত ঈমানকেই বুঝানো হয়েছে, যা মক্কার জীবনে রাসূল সা: ও সাহাবারা পালন করে দেখিয়ে গেছেন। হাজারো শহীদ-গাজীর রক্তের বিনিময়ে মুহাম্মদ সা:-এর হাত দিয়ে ইসলামী খিলাফতের সূচনা হলেও খলিফা ওমর রা:-এর সময়ে তা ব্যাপক প্রসার লাভ করে। খলিফা ওসমান রা:-এর সময়ে মুসলিমদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি ও অনৈক্যের সৃষ্টি হলেও খলিফা আলী রা:-এর শাহাদাতের পর তার পুত্র খলিফা হাসান রা:-এর কয়েকমাসের ইসলামী শাসন পর্যন্ত ৩২ বছর ছিল ইসলামী খিলাফতের মেয়াদ।
হজরত উমর রা:-এর ইসলামী রাষ্ট্র কাঠামো
রাসূল সা: ও আবুবকর রা:-এর মতো উমরের সরকারব্যবস্থাও এককেন্দ্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো। এতে খলিফা ছিলেন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ (সরকারপ্রধান)। তখন পুরো ইসলামী সাম্রাজ্যকে বেশ কিছু প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। প্রদেশ বহির্ভূত আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া অঞ্চলের কিছু স্বায়ত্তশাসিত এলাকাও খিলাফতের অধীনস্থ ছিল। প্রদেশগুলো প্রাদেশিক গভর্নর বা ওয়ালি কর্তৃক শাসিত হতো। উমর রা: সরাসরি ওয়ালিদের নিয়োগ দিতেন। প্রদেশগুলোকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করায় প্রায় ১০০টি জেলা ছিল। প্রতিটি জেলা বা প্রধানশহর একজন অধস্তন গভর্নর বা আমিলের দায়িত্বে থাকত। আমিলরা সরাসরি উমর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও কখনো অনুমতিসাপেক্ষে প্রাদেশিক গভর্নররাও তাদের নিয়োগ দিতে পারতেন। প্রতিটি নিয়োগই লিখিত আকারে দেয়া হতো। প্রাদেশিক অন্যান্য অফিসারদের পদবিন্যাস ছিল নিম্নরূপ-
১. কাতিব : প্রধান সচিব (কেবিনেট সচিব)
২. কাতিব উদ দিওয়ান : সামরিক সচিব
৩. সাহিব উল খারাজ : রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তা
৪. সাহিব উল আহদাস : পুলিশপ্রধান (আইজি)
৫. সাহিব বাইতুল মাল : কোষাগার কর্মকর্তা
৬. কাজী : প্রধান বিচারক (চিফ জাস্টিস)
ওয়ালিরা প্রদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্মরত থাকলেও কিছু প্রদেশে পৃথক সামরিক অফিসার থাকত। নিয়োগের সময় খলিফা উমর রা: কর্তৃক গভর্নরদের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হতো। দায়িত্ব গ্রহণের পর গভর্নররা জনতাকে প্রদেশের প্রধান মসজিদে জড়ো করে তাদের সামনে নির্দেশনা পড়ে শোনাতেন। উমর রা:-এর অধীনে ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রদেশ ছিল নিম্নরূপ-
ক. আরবের মক্কা ও মদিনা দু’টি প্রদেশ;
খ. ইরাকের বসরা ও কুফা দু’টি প্রদেশ;
গ. টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর উচ্চ অংশে আল-জাজিরা একটি প্রদেশ;
ঘ. সিরিয়া একটি প্রদেশ;
ঙ. ফিলিস্তিনের ইলিয়া ও রামলাহ দু’টি প্রদেশ;
চ. মিসরের উচ্চমিসর ও নিম্নমিসর দু’টি প্রদেশ;
ছ. পারস্যের খোরাসান, আজারবাইজান ও ফারস তিনটি প্রদেশ।
রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য উমর রা: বিশেষ বিভাগ গঠন করেন, যা প্রশাসনিক আদালত (ট্রাইব্যুনাল) হিসেবে কাজ করত। এই বিভাগের বিচারিক কর্মকর্তা ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা। গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের ক্ষেত্রে বিচারিক কর্মকর্তা ঘটনাস্থল, অভিযোগ তদন্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণে খলিফা উমরকেও সহায়তা করতেন। ক্ষেত্রবিশেষে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে মদিনায় তলব করে আদালতের সম্মুখীন করা হতো। উমর তার দক্ষ ও সক্রিয় গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের জবাবদিহিরও আওতায় আনতেন। তার বিচারবিভাগীয় সংস্কার সমসাময়িকের চেয়ে বেশি আধুনিক ছিল। হজরত উমর রা: সর্বপ্রথম পাবলিক মিনিস্ট্রি চালু করেন, যেখানে সরকারি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের চাকরির রেকর্ড লিপিবদ্ধ থাকত। গভর্নর ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপিও রেকর্ড হিসেবে রক্ষিত থাকত। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তিনিই প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রে পুলিশবাহিনী সৃষ্টি এবং জনতার নিরাপত্তা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ব্যবহার শুরু করেন।
কবি সাহিত্যিক ও সমালোচক
তথ্যসূত্র: নয়া দিগন্ত।
Tags: Al Islami Khelafat, আল ইসলামি খেলাফত
Home

